আজ এই হেমন্তের সকালে বন্ধুত্বের টানে, প্রাণের আকর্ষণে, অনতিদূর শৈশবের হাতছানিতে আমরা বন্ধুরা সবাই সমবেত হয়েছি। বিভিন্ন বর্ণিল হৃদয়ের উষ্ণ আবেশে আজ আমরা সবাই আবিষ্ট। ঈদের আনন্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে এই মিলনোৎসব।
আজকের এই মিলনোৎসব কে বলা হচ্ছে পুনর্মিলনী বা রি-ইউনিয়ন। এই নামগুলোর কোনটাই আমার কাছে পর্যাপ্ত বা উপযোগী মনে হচ্ছে না। (কারণ, শব্দগুলো এই অনুষ্ঠানের অর্থ/তাৎপর্য প্রকাশে অক্ষম।) পুনর্মিলনীর শাব্দিক অর্থ আবার মিলিত হওয়া, কিন্তু এটা কি আদৌ তাই? আমার মনে হয় না। আমাদের সম্পর্ক অনন্ত-অবিচ্ছেদ্য এবং আজীবনের। যে সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটে তা আসলে বিচ্ছেদ নয়। বরং আমাদের মিলনকে আরও মধুর, আরও গাঢ়, আরও দৃঢ় করার সর্বৈব প্রচেষ্টা। এটা প্রকৃতপক্ষে অন্তহীন বন্ধুত্বের অসীম পথ চলায় সাময়িক বিশ্রাম মাত্র। আমাদের বন্ধুত্বের বিরামহীন পথ চলায় মাঝে মাঝে বিরামচিহ্ন। মাঝে মাঝে পথিকের তেতুল তলে কিংবা বটের ছায়ায় ক্লান্তি জুড়ানো। একে কি বিচ্ছেদ বলা যায়?
বন্ধুত্বের পথে বন্ধুরতা দোষের কিছু নয়। বরং তা মাংসের মাঝে সালাদের স্বাদ। টক-ঝাল-মিষ্টি আর কি। আমাদের কারও কারও মধ্যে কখনো-সখনো মনমালিন্য ঘটে, হয় সম্পর্কের অবনতি। হৃদয়ে ঘটে রক্তক্ষরণ, কাতর হই বিরহ বেদনায়। থাকতে পারি না আলাদা, আবার মিলিতও হই, বন্ধন বেড়ে গিয়ে হয় আরও দৃঢ়। হৃদয়ের মেলবন্ধনে হারিয়ে যায় আবার।
আমাদের বন্ধুত্বের যে স্থিতিস্থাপকতা বা ইলাস্টিসিটি তা পৃথিবীতে ইউনিক। এর তুলনা নেই পৃথিবিতে। পতথিবীর সব স্থিতিস্থাপক পদার্থ মিলেও এত স্থিতিস্থাপকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। আমরা যে যেখানে যত দূরেই থাকি না কেন আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে অটুট।
আজকের এই আনন্দঘন আয়োজন দেখে ইচ্ছে করছে স্মৃতির ভেলায় ভর করে ভেসে চলে যায় আবার স্কুল জীবনে; বাবা-মায়ের, শিক্ষকদের স্নেহমাখা শাসনে শাসিত হই আবার। স্কুল-মাঠে ছুটোছুটি করি, লাফ দিই, ঝাপ দিই, ডানা মেলে উড়াল দিই আবার। কমনরুমে মেয়েদের কলহাস্য, আর তাদের মুখে রাজ্যের গল্পের খই ফোটা, হাসাহাসি, খুনসুটি, পড়াশুনা নিয়ে ঈর্ষাবোধ, টাকা তুলে সিংগারা খাওয়া সব আজ স্মৃতির অ্যালবামে ভরা ছবি মাত্র।
মনে সাধ জাগছে স্কুল জীবনে ফিরে যায়, বড় স্যারের ক্লাশ ফাকি দিয়ে বাজারে গিয়ে সিংগাড়া-জিলাপী খায় মনে পড়ে শাহীন স্যারের দ্রুত গতির পাঠদান, আবহাওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী পায় না আর শহীদুল স্যারের কাছ থেকে। রহীম স্যারের সেই সরস ক্লাশে বসা আর হবে না হয়ত, কিংবা মোবারক স্যারের প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাশে উপস্থিত হব না কোন দিন। বাচ্চু স্যারের কাছ থেকে ভয়েস শেখা হবে না আমাদের আর প্রেরণাও পাব না কমার্সে পড়ার। সময়ের আবর্তে সে সব কিছুই আজ স্মৃতিময় অতীত।
স্কুলের দুটো ক্লাশ হওয়ার পর যদি কখনো হঠাত ছুটির ঘন্টা পরত তাহলে তখন যেমন খুশি হতাম আমি ( ও আমরা) তেমনই খুশি। বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি আমি,তুই, আমরা সবাই। আবেগভরা উচ্ছ্বাশের ছটায় উদ্বেলিত আমরা। এক নৈশব্দিক ভালোলাগা কাজ করছে সবার প্রাণে। আমার সীমাবদ্ধ শব্দ ভান্ডার সেই বল্গাহীন আনন্দকে ভাষায় প্রকাশে অক্ষম। সবার চোখের তারায় তারায় এর নীরব প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি আমি।
আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা আমি যখন ৭০ বছরের বৃদ্ধ তখনও যেন লাঠিতে ভর দিয়েই হোক আর নাতি-নাতনীর কাঁধে ভর দিয়েই হোক এই মিলনৎসবে যেন আসতে পারি। ফিরে যেতে পারি আমার স্মৃতিময় স্কুল জীবনে।
যে বিনা সুতার মালা রচিত হয়েছে এবং হৃদয়ের সাথে হ্রিইদয়ের যে মেলবন্ধন স্থাপিত হয়েছে তা যেন আমৃত্যু বজায় থাকে, সে কামনা করে শেষ করছি আর হ্যা আজ জারা আসতে পারে নি যে কারণেই হোক তাদেরকে ভবিষ্যতে পাব সে আশা করছি। শুভকামনায় তোদের সব সময়ের সুভাকাঙ্ক্ষী---তারিক।
(পুনর্মিলনী-২০১০ উপলক্ষ্যে পঠিত উদ্বোধনী বক্তব্য)
গাংনী,
১৮.১১.১০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন