শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ভাষা বিতর্ক এবং আমার অবস্থান


          সম্প্রতি ভাষা বিষয়ে বিতর্ক বেশ জমে উঠেছে। দেশের রাজনীতির খবরের মতই তা বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে; লোকজন ভাষা বিষয়ক নীরস এই সকল আলোচনা বেশ মনোযোগ দিয়েই পাঠ করছে এবং অনলাইনে এই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে বেশ বাদানুবাদ লক্ষ্য করছি।আমি আগেই পরিস্কার করে বলতে চাই আমি ভাষা বিশেষজ্ঞ নয়; বরং বলতে পারেন বিশেষ অজ্ঞ।ভাষা সম্পর্কে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়েই আমার উপলব্ধিটাকে প্রকাশ করতে চাচ্ছি।
বর্তমানে ভাষা বিষয়ে উত্থিত গুরুত্বপূর্ণ ৫টি প্রশ্ন নিম্নরুপঃ
১। রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরি প্রণীত প্রমীত বাংলা কি আমাদের অনুসরণ করা উচিত কিনা?
২। ভগীরথীর তীরবর্তী লোকেদের ভাষা প্রাধান্য পেলে বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী লোকেদের ভাষা প্রাধান্য কেন পাবে না?
৩। ভাষার ক্ষেত্রে আদর্শ থাকা উচিত কিনা?
৪। উপরের প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যা হয়, তবে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে আদর্শ বা স্ট্যান্ডার্ড কি?
৫। ভাষার বিচারে যদি মানুষের মুখের ভাষায় মুখ্য হয়ে থাকে তবে আমাদের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে করণীয় কি?

উত্তরের আগে পরীক্ষার খাতায় একটা ভুমিকা লেখা হয়ে থাকে। আমিও মূল উত্তরে যাবার পূর্বে একটু ভুমিকা সেরে নিতে চাই। ভাষা বিষয়ে পৃথিবীর বহু বিদগ্ধ বুজুর্গ ব্যাক্তি মতামত দিয়ে গেছেন;উনাদের মধ্যে আমাদের পুরাকালের পাণিনি থেকে শুরু করে হালের হুমায়ুন আজাদও আছেন। উনারা সবাই একটা বিষয়ে অন্তত একমত যে ভাষা শাসনের তোয়াক্কা করে না।আমরা ভাষা নিয়ে যতই সভা-সমাবেশ করি না কেন, মিটিং মিছিল করি না কেন,কোন ফায়দা নাই। ভাষা প্রবাহমান নদীর মতই নিজ গতিতে ধাবমান।
এবার আসি উত্তরে। আমাদের বর্তমান প্রমীত বাংলা রবীন্দ্রনাথ কিংবা প্রমথ চৌধুরী প্রণীত বলে কি গ্রহণে কোন সমস্যা আছে? আমার উত্তর হল না। লোকের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত ঢেলে খাওয়ার ইচ্ছা আমার নাই। কুকুরে আমার প্রিয়ো পোশাক ছুঁয়েছে বলে কি আমি আমার পোশাকটা ফেলে দেব? আমি তা ধুয়ে নিয়ে পরবো। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরীর প্রসঙ্গ আসছে মূলত দুইটি বিবেচনা থেকে; প্রথমত, তাঁরা ভারতীয়(অর্থাৎ ওপার বাংলার )। দ্বিতীয়ত, তাঁরা হিন্দু।

          অভিযোগ পুরাতন। ’৪৭শে ভারত ভাগের পর পাকিস্তানে(বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানে) রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হল।তাঁর গান রেডিওতে প্রচার করা হত না,তাঁর কবিতা মঞ্চে পাঠ করা হত না,তার সাহিত্য নিয়ে জাতীয় পরিমন্ডলে আলোচনা হত না।তার সব কিছুতেই যেন হিন্দুয়ানীর একটা ভাব খুঁজে পেল তৎকালীন পাকিস্তানিরা।বাঙ্গালিও কম যায় না।দলে দলে সভা করে, পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে জানান দিলো যে রবীন্দ্রনাথের কোন কিছু তারা চর্চা করবে না।এ দলে এমন অনেক লোক ছিল যারা পরবর্তীতে সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁদের নাম শুনলে আপনিও আতকে উঠবেন।আমি তাঁদের নাম উল্লেখ করে সাময়িক কৃত ভুলের জন্য বেইজ্জতি করতে চাই না। একজন হিন্দু যেমন মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে সর্বপ্রথম গরুর গসতো খাওয়াকে ফরজ মনে করে, তেমনি চিরদিনের হুজুগে বাঙালি সেই সময় পাকিস্তানের জন্মের সাথে সাথে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সন্তান রবি ঠাকুরকে ঝেটিয়ে তাড়াবার ব্যবস্থা করলো। সেদিন তারা বুঝতে পারে নি, রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে বাংলার যে অঙ্গহানি ঘটে তা কোন মেকাপে বা সার্জারিতে পূরণ করা সম্ভব নয়।  আর বাংলার বার্ট্রান্ড রাসেল নামে খ্যাত পন্ডিত প্রমথ চৌধুরিকে নিয়েও কোন বিতর্ক থকতে পারে না।তিনি যা করেছেন তা তার তুলনা কেবল বড় কোন ধর্ম সংস্কারকের সাথেই হতে পারে।মরা নদী খনন করে যেমন নদীর গতিপথ ঠিক করা হয়, তেমনি তিনি বাংলা ভাষার একটা একটা ফর্ম দাড় করিয়ে বাংলা ভাষা চলার পথে দিক ও বেগ যুক্ত করেন।এজন্য তিনি বাংলাভাষী সকলের কাছ থেকেই প্রশংসার দাবিদার।  
           
এখন আসি রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ বাবুকে আমরা অনুসরণ করবো কিনা সে বিষয়ে। সাহিত্যে তারা অনুসরণীয় ব্যাক্তিত্ব। কিন্তু তাই বলে হুবুহুবু? না, সেটা সম্ভব না। ভাষা তার নিজের তাগিদেই সেটা হতে দেবে না।আজকের প্রমীত বাংলার সাথে রবি ঠাকুরের কিংবা প্রমথ বাবুর বাংলার বহু ফারাক আছে।সময়ই সে ব্যবধান সৃষ্টি করে দিয়েছে; যেগুলো চলনসই ঠিক সে শব্দগুলোই চলে এসেছে আর পথিমধ্যে নতুন নতুন আরও অনেক শব্দই সে যাত্রাই সামিল হয়েছে।বুড়-অথর্ব,অকেজো শুব্দগুলো পথের মাঝে মুখ থুবড়ে পড়ে মৃত্যু মুখে নিপতিত হয়েছে। আর আমাদের মৌখিক ভাষার ক্ষেত্রে এ বিষয়ে বাক্যপাত সম্পূর্ণ নিরর্থক। কারণ, কথা বলার সময় আমরা এতটা গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারি না। সেটা করলে বর্তমানে আতলামি হিসাবে বিবেচিত হবে।
আমার বাড়ি মেহেরপুর জেলায়। এই অঞ্চলটি আগের দিনে নদীয়া জেলার মধ্যে ছিল।সেই সূত্রে আমাদের মুখের ভাষা বেশ খানিকটা প্রমীত বাংলার কাছাকাছি।এজন্য মনে মনে কিছুটা গর্ববোধও করি। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাকে ছোট করে দেখি না।আমাদেরও কিছুটা আঞ্চলিকতা আছে।যেমন ‘খেতে যাচ্ছি’ কে বলি ‘খাইতে যাইছি’, ‘করেছি’ কে বলি ‘কইরিছি’,ইত্যাদি অসংখ্য উদাহরণ টানা যায়।আমি মনে করি এটা আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ।অন্যদের বুঝতে কষ্ট হবে; কষ্ট দিয়ে লাভ নাই।
ভগীরথী তীরবর্তী লোকেদের ভাষা পরবর্তীতে প্রমীত রূপ লাভ করে তবে সম্পূর্ণভাবে না, কাটছাঁটের পরে। এখন কিছু লোক মনে করে সে সময় অখন্ড ভারতে ভগীরথীর ভাষা প্রমীত হলে আজকের স্বাধীন বাংলায় কেন বুড়িগঙ্গার ভাষা প্রমীত কেন হবে না? ভাষা কেবল ভূ-রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটা সাধারণের বোধগম্যতার সাথে জড়িত। আর তা না হলে, ’৪৭ এর পর আমাদের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হয়ে যেত।তা হয় নি। আমরা বর্তমানে যে ভাষায় কথা বলছি সে ভাষায় কথা বললে ভারতীয়ও হয়ে যাব না।পৃথিবীর ইংরেজি ভাষাভাষী তাবৎ লোকের জাতীয়তা ইংরেজ নয়।
ভগীরথীর সেই ভাষা অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের প্রমীত যে রূপ লাভ করেছে তা ভারতের নয়;সেটা বাংলাদেশী। বাংলাদেশের সকলে সে ভাষা বোঝে। কিন্তু হঠাৎ করে ঢাকার কিংবা চট্রগ্রামের অথবা সিলেটের বা রংপুরের ভাষাকে প্রমীত করা হলে জাতি চোখেমুখে অন্ধকার দেখবে। বরং তার চেয়ে ইংরেজি জানা লোকের সংখ্যাই বেশি।সকলের বুঝার স্বার্থে,সুবিধার স্বার্থে বুড়িগঙ্গা না ভগীরথীর পরিশোধিত বাংলাই লাগসই হবে।
ভাষার ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ থাকা উচিত কিনা-এটি অত্যন্ত গোলমেলে বিষয়।এ বিষয়ে এ পর্যন্ত বহু বাক বিতান্ড হয়েছে।ভাষার আসলে আদর্শ বলে কিছু নেই। নদীর পানিতে কত ধরণের ময়লা-মাটি থাকে তারপরও নদীর পানি পবিত্র; তা দিয়ে অজু হয়। ভাষা তো নদীর গতিশীল;চলার পথে অনেক শব্দ নিয়ে নেয়, আবার অদরকারি শব্দ ফেলেও যায়।ভাষার ক্ষেত্রে আমি সীমত পর্যায়ে আদর্শ বজায় রাখার পক্ষে।কারণ তা না হলে ভুল বোঝবুঝির মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।লেখায় সব ভাষারই একটা আদর্শ থাকে,যাতে ঐ ভাষার সকল পাঠক অনায়াসে পড়ে বুঝতে পারে। পৃথিবীর সার্বাধিক দেশে ব্যবহৃত ভাষা ইংরেজি।কিন্তু প্রায় সকল অঞ্চলেই উচ্চারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বহুবিধ পার্থক্য বিদ্যমান।খোদ ইংল্যান্ডের ৪৮টি কাউন্টিতেই আছে উচ্চারণের ভিন্নতা। তারপরও তারা একটা মিনিমাম আদর্শ বজায় রাখে লেখাতে এবং বলাতে। উচ্চারণসহ অক্সফোর্ড ডিকশোনারিই তার বড় প্রমাণ। তা না হলে বিশ্বব্যপী যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক ব্যপক গোলযোগ দেখা দিত। লোকজন আরও বেশি স্থিতিশীল কোন ভাষায় যোগাযোগ শুরু করতো। সে জন্য একটা আদর্শ রূপের দরকার আছে।ভাষা তার নিজস্ব প্রয়োজনেই নতুন নতুন শব্দ আত্তীকরন করে নেবে,অপ্রয়োজনীয় শব্দ বা উচ্চারণ বাদ দিয়ে দেবে।
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু মানুষের মুখের ভাষা বাংলা।আঞ্চলিকতাসহ বাক্য গঠন ও শব্দ প্রয়োগে পার্থক্য থাকা  খুবই স্বাভাবিক।তাই বলে কি ভাষার ক্ষেত্রে সামন্তশাসন চলতে থাকবে।তা হলে তো কেউই অন্যদের ভাষা বুঝতে পারবে না।আজ হঠাৎ করে যদি ঢাকার আঞ্চলিক ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করা হয়, বই-পস্তুক সব সে ভাষাতেই লেখা হয় তবে আমরা কি তা পুরোপুরি বুঝতে পারবো? বোধয় অনেকেই পারবে না।কিন্তু আমি যে ভাষারীতি ব্যবহার করে এই লেখাটি লিখছি, বাংলা ভাষাভাষী কোন লোকের পক্ষে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। তাছাড়া আর একড়া প্রশ্ন তো তখনই দেখা দিবে, রংপুরের লোকও তো তাদের আঞ্চলিক ভাষাকে জাতীয় ভাষা করার দাবিতে ফেটে পড়বে। অর্থাৎ অবস্থা আরও গুরুতর আকার ধারণ করবে।
আঞ্চলিক ভাষা অসম্মানের নয়;তা বরং মুখের ভাষা,মায়ের ভাষা,প্রাণের ভাষা।সে ভাষাতে কথা বলার,ভাব বিনিময়ের অধিকার আমার,আপনার,সবার আছে।মাতৃভাষার জন্য যে জাতি প্রাণ দিয়েছে সে জাতির লোক তো মায়ের ভাষায় কথা বলবেই।কিন্তু দুঃখ লাগে তখন, যখন এক দল শিক্ষিত আহাম্মক  বাড়াবাড়ি করে। ইচ্ছাকৃতভাবেই তারা লোকের মাঝে বেশি আঞ্চলিকতা জাহির করে।এটা শ্রেফ ভন্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়।
এবার আসি আমাদের কিছু সাহিত্যিকের কথায়।তারা ইদানিং ব্যপক বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। ফেইসবুকে আঞ্চলিক ভাষায় স্ট্যাটাস দিয়ে এর পক্ষে যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা জ্ঞান ফলাচ্ছে। ভদ্রগণের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি,আপনাদের স্ট্যাটাস পড়তে আমাদের কষ্ট হয়। ভাষা হচ্ছে ভাবের বাহন।ভাব ঠিক থাকলে তা এমনিতেই গুরুত্ব পাবে, তা আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হলেও।বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য থেকে আমি অনেক উদাহরণ দিতে পারি।আর গায়ে গোসত না খালি মেকাপ লাগাবেন-তাতে সাময়িক কাজ হলেও অদূর ভবিষ্যতে পাঠক তা ছুড়ে ফেলে দেবে।
          যদি ভালো কিছু হয় তবে তা গ্রহণে আমরা যদি আপত্তি করি তবে তা হবে ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট বিরোধী।ভাষা কোন দিন কোন কালে কি বাক্সবন্দি থেকেছে?ভাষা তো নদীর মত ,চলতি পথে যা পায় তা-ই সে আপন করে নেয়।এটা অবস্য সয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া। জবরদস্তি সেখানে খাটে না। আর্যরা,মুঙ্গলরা,আরবরা,আফগানরা,ইংরেজরা এসেছে কিন্তু তারা কি ভাষাকে শাসন করতে পেরেছে? পারে নি। তখনকার রাজা-বাদশারা উদ্যোগ নিয়েছে ভাষা পরিবর্তনের, কিন্তু ব্যার্থ হয়েছে তাদের সকল প্রচেষ্টা।বাংলার আপামর জনগণ যে ভাষা ব্যবহার করবে সে ভাষা-ই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে টিকে থাকবে যুগযুগ ধরে।

মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১১

♥ ♥ ♥ প্রেম তত্ত্ব ♥ ♥ ♥


গাছ বাদে ফুলের ঘ্রাণ কে কবে পেলো শুনি?
সাধক সে জন,পীর-দরবেশ, নয়তো ঋষি-মুণি।
দেহ বাদে প্রেমের কথা বলে যে জন
জেনে রেখ, মিথ্যা বলে সে, মিথ্যুক সে জন।
না ঘুমিয়ে স্বপ্ন যারা দেখে
তা স্বপ্ন নয় হে, সে যে দিবাস্বপ্ন
ভ্রান্তি তাহার চোখে-মুখে।
অংকের ভাষায়, মন হল দেহের এক জটিল ফাংশন।
জানা নেই আমার, এর থেকে কোন সত্য ভাষন।

শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১১

আমার বন্ধু সোহেল

                                 “তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়? 
                      দুঃখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয় 
                                  তিলে তিলে তার ক্ষয়।।
                      আমি তো দেখেছি কত যে স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে যায়।’’

          হ্যাঁ দেখেছি।আমি মুকুল ঝরে যেতে দেখেছি। তবে কেবল মুকুলই নয়; আমি ফুটন্ত কলিও ঝরে যেতে দেখেছি। সোহেল কেবল মুকুল নয় সে সম্পূর্ণ ফুল হয়ে উঠতে যাওয়া বিকাশমান একটি কলি। সামান্য সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আর একটু সুযোগ পেলেই সে ফুল হয়ে উঠতে পারে।

          আমি মোঃ সোহেল রানা’র কথা বলছি। আমার বন্ধু সোহেলের কথা বলছি।সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অষ্টম সেমিস্টারের ছাত্র। আর ছয়টি মাস পার হলেই একজন গ্রাজুয়েট।কিন্তু হায়,ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! এই পূর্ণিমা তিথির পূর্ণ চাঁদ উঠার আগেই তাকে গ্রাস করতে ছুটে এসেছে এক দুষ্টগ্রহ । সোহেলের কিডনীতে বাসা বেঁধেছে এক দূরারোগ্য ব্যধি।রোগটির নাম-Chronic Glomerulonephritis with Hypertension with End Stage Renal Failure on Heamo-dialysis.তার দুটি কিডনীই এখন অচল প্রায়।ডায়ালাইসিস করে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ছোট হয়ে গেছে তার কিডনী দুটি,ছোট হয়ে এসেছে তার পৃথিবী, কিন্তু বেঁচে থাকার আশাটা বড় বেশি তার।

           টাঙ্গাইল জেলার ভুয়াপুর উপজেলার রামপুর গ্রামের এক দরিদ্র দিনমজুর মোঃ আব্দুস সামাদের বড় ছেলে সোহেল।বাবা-মার ঘামে ভেজা অর্থে আর তার নিজের প্রচেষ্টাই সে আজ এখানে। মিরপুরে এক মামার বাসায় থেকে টিউশন করে,কোচিং সেন্টারে ক্লাশ নিয়ে নিজের এবং তার আদরের একমাত্র ছোট বোনটির পড়াশুনার খরচ চালাতো সে। অনার্স শেষ হলেই একটা চাকরি করবে,বোনটির দায়িত্ব নেবে আর বাবা-মা কে ছুটি দেবে; এই তার আশা।তার জীবন তার মত করে গুছিয়ে নেবে সে।কিন্তু তার সে আশা আজ থমকে দাঁড়িয়ে গেছে।
তারাশঙ্কর সেই কবি’র মত করেই সোহেল বেডে শুয়ে আজ আমাকে প্রশ্ন করেছিল,
                            “হায়! জীবন এত ছোট কেনে!
                                    এ ভুবনে
                   জীবনে যা মিটল নাকো, মিটবে কি তা মরণে?’’
         আমি তার এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর করতে পারি নি। আমতা আমতা করে যা বলে ছিলাম তা কোন উত্তর নয়;শুধু সান্ত্বনার বাণী। আমি বলেছিলাম, ‘জীবন কোনো দিন শূন্যে গিয়ে থামবে না।তবে দূঃখ? হ্যাঁ, দুঃখ আছে। থাকবে।আর তা আছে বলেই মানুষ আশা দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে বিশ্বাস দিয়ে তার সঙ্গে বোঝাপাড়া করে বেঁচে থাকে। তোরও নিশ্চয় অসুখ সেরে যাবে।এ আর এমন কী! কিডিনী ট্রান্সপ্লান্ট করলেই তুই সুস্থ হয়ে যাবি।আগের মত ক্যাম্পাসে আসতে পারবি, আড্ডা দিবি ঠিক আগের মতই। একদম চিন্তা করবি না,আমরা আছি না তোর সাথে? জীবন তো এই রকমই-নানা বর্ণে বেদনায় রঞ্জিত এক উপন্যাসের মত। ’

          জানি না এটি সত্য না কোন মিথ্য প্রলোভন। তাকে নিয়ে সৃষ্টিকর্তার খেয়ালও আমাদের অজানা।শুধু জানি, আমার বন্ধুটি এ পৃথিবীর রং-রূপ-রস ঠিক মত না বুঝেই চলে যেতে বসেছে।এই জীবনটা ভালো কিংবা মন্দ কিংবা যা-হোক-একটা-কিছু সে কথাটাও বোঝার সময় পাচ্ছে না সে।জীবন তাকে সে সুযোগ দিচ্ছে না।কখন সে জীবনের মাঝে মগ্ন হয়ে জীবন কে উপভোগ করতে পারবে না আর।

       জীবনের ধারা চলতে চলতে তার যে সব চিহ্ন বিছিয়ে যায় সেগুলোর স্মৃতিচিহ্ন তার আশেপাশের মানুষদের কে বড় কষ্ট দেয়।আমরাও সেরকম কষ্টে ভুগছি।তার সাথে কাটানো দিনগুলোর কথা আজ বারবার মনে পড়ছে,চোখের সামনে ভেসে উঠছে একেবারে জীবন্ত হয়ে।আমরা প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে শ্যাডোর নিচে আড্ডা দিতাম।সোহেল বেশ রসিক ছিল।কথা কম বলতো;কিন্তু কথায় অনেক উইট থাকতো।তার বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকে আমরা হাসতে হাসতে ফেটে পড়তাম।

           আমরা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র।অনেক ট্রাজেডি পড়েছি এবং পড়ছি আমরা ।কিন্তু সোহেলের মত মর্মান্তিক জীবন্ত ট্রাজিক হিরো জীবনে দেখি নি।প্রকৃতির হাতে নির্মম-নির্দয় ট্রাজিক পরিণতি।

           সেই সোহেল আজ অসুস্থ।মারাত্বক ভাবে অসুস্থ।কিন্তু বেঁচে থাকার আকুলতা তার প্রবল।বাঁচার একমাত্র উপায় কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট করানো।এর জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ।সে অর্থ তার কিংবা তার পরিবারের নাই।তাই বলে কি সোহেল অর্থাভাবে,চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে? তা কখনো হতে দেব না আমরা।জীবন মানুষের একটাই; সেই জীবন কে এভাবে খরচ হতে দেব না আমরা।
                           '' মানুষ মানুষের জন্যে জীবন জীবনেরজন্যে
                       একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?''

প্রিয় আজম খান

(উৎসর্গঃ বাংলার পপগুরু আজম খান কে)

কি আর লিখব কবিতায়?
যখন সমগ্র জাতি শোকার্ত
তোমাকে হারানোর বেদনায়।
শহীদ মিনারে  হাজারো মানুষের ভিড়ে
যে সোকগাথা রচিত হয়েছে
তা কি আমি লিখতে পারবো
মাত্র কয়েক লাইন কবিতায়?

আমি জসীমউদ্দীন লেনে
কতদিন পিছু নিয়েছি গোপনে।
তুমি জানতেও পারোনি তা।
তোমার লম্বা লম্বা পা ফেলে
যখন হাটতে উদাস ভঙ্গিতে
এক হাতে ঝোলা ব্যাগ, অন্য হাত পকেটে
সবজি বাজার ঘুরে মাছের বাজারে যেতে না যেতেই
একদল কৌতূহলী ভক্ত যেত জুটে
কলোনির সেই কমবুঝ ছেলেগুলো
আজও হয়তো চেয়ে থাকে
এই বুঝি তুমি চলে আসবে
ক্ষণিক পাশে বসবে,
কিংবা খেলবে তাদের সাথে।
...
...
রেললাইনের বস্তির সেই ছেলেটি
বড় হয়ে যখন তোমায় খুজবে
কি বলবো তাকে? তা তো  বলনি।
প্রতিদিন কত আলাল-দুলাল
হারায় চাঁনখারপুলে
তাদের খোঁজে কে বল আর গান গাবে
অমন হৃদয় খুলে?
বিড়ি আর গাঁজার ধোয়ার মাঝে
তুমি প্রথম যেদিন গেয়েছিলে গান
সেদিনই বুঝেছিল সবাই
তুমি হবে সাধারণ জনতার প্রাণ।
সালেকা,মালেকা,  আর পাঁপড়িরা
তোমার কারণে ভাষা পেল নীচজরা।

যতদিন শোনা যাবে বাংলা ভাষায় গান
ততদিন থাকবে তুমি প্রিয় আজম খান।

আমি নারী

সুন্দরীরা সব অবাক
আমার কি আছে এমন?
মডেল কন্যাদের মত না হয়েও
কিভাবে আমি অনেক পুরুষের স্বপন?
জবাবে আমি যখন কিছু বলি
তারা ভাবে আমি মিথ্যার ঝুলি।
আমি বলি-
পুরুষের আকর্ষন আমার সুডৌল বাহু।
আর আমার কোমোরেরে দুলনি।
নারী সুলভ আড়ষ্ঠ পদক্ষেপ
কিংবা আমার বাঁকা চাহনি।
আমি একজন নারী
পৃথিবীর মহাঘটিয়সী
বহু ঘটনার জন্মদান কারী।

আমি হাঁটাহাঁটি করি ঘরে
ঠিক তোমাদের মত করে।
কিন্তু কোন পুরুষের সম্মুখে
ঠাঁয় দাঁড়ায়ে যায়।
নত মস্তকে সে কাচুমাচু মুখে
তোষামদ করে আমায়।
আশেপাশে ঘুর ঘুর করে
পুরুষ মৌমাছি্রা যেমন ঘোরে
রানীর সাথে সঙ্গম লিপ্সায়।
আমি বলি-
এত কিছুর কারণ
আমার বাঁকা ভ্রুর নাচন।
কিংবা আমার রহস্যভরা হাসি।
অথবা চপল পা দুখানির কারসাজি।
আমি একজন নারী;
পৃথিবীর মহাঘটিয়সী
বহু ঘটনার জন্মদান কারী।

পুরুষের চোখেও আমি বিস্ময়।
দূর থেকে চেয়ে দেখে,
প্রচুর চেষ্টা করে,
তবুও স্পর্শের স্পর্ধা নাহি কুলায়।
নারী হৃদয়ের চির রহস্য
যখন দেখাতে চাই।
তারা বলে,
হে নারী, কুল নাহি পায়।
আমি বলি-
এত কিছুর কারণ
আমার পিঠের মসৃন আবরণ।
অথবা আমার যত্ন করা মুখখানি।
কিংবা বুকের উত্থিত মাংসপিন্ডসহ
আমার যৌবনপুষ্ট দেহখানি।
আমি একজন নারী;
পৃথিবীর মহাঘটিয়সী
বহু ঘটনার জন্মদান কারী।

এখন তুমি বুঝবে
কেন আমি এত দুর্বিনীত।
অনুরোধ কিংবা তোষামোদ ছাড়ায়
এক ভ্রুর নাচনে, কাজ যখন হয় শত।
তোমার পাশ দিয়ে আমি যখন হাঁটি
গর্বে তোমার বুকটা যায় ফাটি।
আমি বলি-
এত কিছুর কারণ,
আমার চঞ্চল হাটন।
অথবা আমার চুলের মদির ঘ্রাণ।
কিংবা আমার নরম হাতের ছোয়ায়
আছে যখন বহু সঞ্জিবনী প্রাণ।
কারণ আমি একজন নারী।
পৃথিবীর মহাঘটিয়সী
বহু ঘটনার জন্মদান কারী।
[Maya Angel-এর একটি জনপ্রিয় কবিতা থেকে থিম এবং ফর্ম ধার নিয়েছি।]

লুকানো ব্যথা

তোমরা আমায় হাসতে দেখো
গাইতে দেখো গান,
কেউ কখনো  দেখেছো কি
এ বুকে ব্যথার পরিমান?

সবুজ ঘেরা পাহাড় দেখো
কখনো পেতেছো কি তাতে কান?
কঠিন শিলার কঠিন হৃদয়
তারও আছে গোপন অভিমান।

সেই পাহাড়ের মর্মব্যথা
লুকানো সব গোপন কথা,
অশ্রু হয়ে ঝরে তারা।
মনোহরা ঝর্ণাধারা!

হে মনমিতা

হে মনমিতা, চেয়ে দেখ আমার চোখের তারায়
তোমার চোখে আমার ছবি,
আর আমার চোখে খুজে পাবে তোমায়।
এই আমি কথা দিচ্ছি তোমায়।
এক বার যদি কিস দাও ঐ পানির গ্লাসে
আর কোনদিনও মুখ দেব না বিয়ার কিংবা ভোদকায়।
যে তৃষা জাগিয়েছো তুমি আমার এ প্রাণে,
হাউজে কাওসারের পানিতে মিটবে না তা
কিংবা মিটবে না তা  গঙ্গার পবিত্র জল পানে।
সেদিনের দেওয়া সেই গোলাপ ফুলের তোড়া
কোন ভণিতা কিংবা লৌকিকতা নয়,
সবটুকু আমার বিশুদ্ধ প্রেমে মোড়া।
দিয়েছিনু এ আশায় নয় যে কেবল তুমি নেবে ঘ্রাণ
বরং নিঃশ্বাসের সাথে ছুড়ে দেবে তুমি মদনের বান।
তোমার নিঃশ্বাসের সৌরভে হল সে ফুল সৌরভময়
তারই মঝে আমি, হে মনমিতা,খুজে পেলাম তোমায়।